21/05/2025 : Wednesday
Trip No.: - 28কিছুদিন আগে আমি ২ টো tour plan তৈরী করেছিলাম - আসানসোল trip আর মায়াপুর trip. কিন্তু আজ কোন জায়গায় যাবো সেটাই ঠিক করতে পারছিলাম না। একবার মনে হচ্ছিল আসানসোল যাই আবার মনে হচ্ছিল আসানসোল পরে যাবো আগে মায়াপুর থেকে ঘুরে আসি। এবার গত কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হওয়ার কারণে এখন গরম একটু কম তাই ঠিক করলাম আসানসোল থেকেই ঘুরে আসি কারণ বেশি গরম থাকলে আসানসোলের দিকে যাওয়া যাবে না। আমাদের পূর্ব বর্ধমানের তুলনায় পশ্চিম বর্ধমানে গরম একটু বেশিই থাকে।
আজ সমস্ত preparation নিয়ে বাড়ি থেকে সকাল ৫ টায় বের হলাম। বর্ধমান থেকে Durgapur Expressway ধরে এগিয়ে চললাম। বুদবুদ আসার পর রাস্তার ধারে ১৫ মিনিটের জন্য দাঁড়ালাম। ফ্লাস্কে চা করেই এনেছিলাম। চা-বিস্কুট খেয়ে আবার এগোতে শুরু করলাম। বেশ মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিলাম। আমি ভাবতেই পারি নি সামনে আমার জন্যে কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করে রয়েছে।
কিছুদূর আসার পর দেখলাম একটা accident হয়েছে। main road বন্ধ। সমস্ত গাড়ি service road দিয়ে পাস করাচ্ছে। এবার সেখানে রাস্তায় গলা পিচ বা আলকাতরা জাতীয় কিছু একটা পড়ে আছে একেবারে দু-ইঞ্চি পুরু হয়ে। তরল কিন্তু খুব পুরু, আঠালো, চ্যাটচ্যাটে। সমস্ত গাড়িই আস্তে আস্তে এগোচ্ছে। সামনে দেখতে পাচ্ছি লরি বা বড়ো গাড়ি গুলোও skid করছে। তাহলেই ভাবো কি অবস্থা। আমার তো দেখেই ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। পিছোনোর ও কোনো উপায় নেই, অন্য দিকে যাওয়ার ও কোনো উপায় নেই। আমি দেখলাম আমার সামনে দুটি বাইক ওই রাস্তায় যেতে যেতে পড়ে গেল, তারা ওই চ্যাটচ্যাটে জিনিসটায় পুরো মাখামাখি হয়ে গেল। আমি তো ভাবছি স্কুটি নিয়ে পেরোবো কি করে, সামনে প্রায় ৫০০ মিটার রাস্তা এই অবস্থা। প্রচুর slippery, চাকা খুব skid করছে, আমি ইষ্টদেবতা স্মরণ করে এগিয়ে চলেছি। একবার আমার স্কুটির চাকা slip করে একটা পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া লরির চাকার সাথে ঠেকে গেল, লরি টা সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেল তাই, নাহলে আমি চাপাই পড়ে যেতাম। ওই রাস্তাটা এতটা slippery হয়ে গেছে, দাঁড়িয়ে থাকলেও slip করছে। এইভাবেই কোনো রকমে একবার ও রাস্তায় পড়ে না গিয়ে ৫০০ মিটার রাস্তা finally পার করে এলাম। স্কুটির নিচের অংশ চাকা সহ ওই চ্যাটচ্যাটে আলকাতরার মত জিনিসটায় ভর্তি হয়ে গেছে, আমার জুতো ও পুরো মাখামাখি। আমি একবার দাঁড়ালাম, স্কুটির দিকে তাকিয়ে আমার কান্না পেয়ে গেল, স্কুটিটাকে এত ভালোবাসি, সবসময় পরিষ্কার করে রাখি, তার এই অবস্থা আমি দেখতে পারছিলাম না।
একবার ভাবলাম বাড়ি ফিরে যাই, তারপরেই ভাবলাম এতটা রাস্তা যখন চলে এসেছি ঘুরেই যাই, মনটাও একটু ভালো হবে। আমার গাড়ির toolbox-এ ছিল "WD-40" spray. সেটা গাড়ির নিচের সমস্ত অংশে, চাকায়, আমার জুতোতে spray করে নিলাম। ওই চ্যাটচ্যাটে জিনিসটা কিছুটা হলেও গলে গেল। তারপর এগিয়ে চললাম আজকের প্রথম গন্তব্যের দিকে।
1. Blue Factory Mines Lake
Google map দেখে সকাল ৮ টায় পৌঁছে গেলাম আজকের প্রথম গন্তব্য Blue Factory Mines Lake. রাস্তা পরিষ্কার থাকলে হয়তো আরো আগেই পৌঁছাতাম। এটি আসানসোলের মাজিয়ারাতে অবস্থিত। এতো সুন্দর জায়গা দেখে আমার মন অনেকটাই ভালো হয়ে গেল।

আসানসোলের কাছে মাজিয়ারা তে অবস্থিত এই Blue Factory Mines আগে একটি কয়লাখনি ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন বেসরকারি খনি সংস্থাগুলি আসানসোল-কুলটি-রানিগঞ্জ অঞ্চলে কয়লা উত্তোলন করা শুরু করে তখন এই কয়লাখনিটির সৃষ্টি হয়।
পরবর্তীকালে এই কয়লাখনিটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টির জল জমতে জমতে আজ এই মনোমুগ্ধকর blue-green lake-এর সৃষ্টি করেছে। এই Lake টি খুবই গভীর, কিছু কিছু জায়গা প্রায় ৩০০ ফুট গভীর হবে। তাই এখানে এলে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
এই Lake-এর জল খুবই স্বচ্ছ এবং গভীরতা আর খনিজ পদার্থের উপস্থিতির কারণে জল নীল রং-এর দেখায়।
এই Lake-এর প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। এখানে আসার উপযুক্ত সময় হল সূর্যাস্তের সময়, তবে সূর্যোদয়ের সময়েও ভালো লাগবে।
গাড়ি রেখে লেকের চারিদিকে ঘুরতে খুব ভালো লাগছিল। সকালের মিঠে রোদ্দুর তার সাথে বেশ সুন্দর হাওয়াও দিচ্ছিল। চারিদিক ঘোরার পর লেকের নিচের দিকে নেমে গেলাম, জল স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। বেশ কিছু ছবি তোলার পর আবার উঠে এসে একটা পাথরের উপর বসে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম। লেকের মাঝে একটি দ্বীপের মত জায়গা আছে যার জন্য এর সৌন্দর্য আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
সকালে আসার পথের ভয়ানক অভিজ্ঞতার পর যে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল এখানে এসে মন একেবারে ভালো হয়ে গেল। ঘড়িতে এখন সময় সকাল ৯টা। এরপর উঠতে হবে, যেতে হবে ফুলবেড়িয়া পরবর্তী গন্তব্যে।
2. মা মুক্তাই চন্ডী পাহাড় ও মন্দির
Blue factory mines lake থেকে ফুলবেড়িয়া তে এই মুক্তাই চন্ডী পাহাড় ২১ কিমি দূর। Google map দেখে আমি সকাল ৯:৪৫-এ পৌঁছে গেলাম মুক্তাই চন্ডী পাহাড়ের মন্দিরের সামনে। চারিদিক গাছপালায় ঘেরা খুব সুন্দর পরিবেশ, শহরের কোলাহল থেকে অনেকটাই দূরে। সামনে বিস্তৃত মাঠ, সেখানেই একটি গাছের নিচে গাড়ি রাখলাম।

আসানসোল শহর থেকে কিছুটা দূরে ফুলবেড়িয়ার সামডি গ্রামে একটি ছোট্ট টিলার উপর রয়েছে মা মুক্তাইচন্ডী মন্দির। সুউচ্চ চূড়া বিশিষ্ট, কারুকার্য শোভিত খুবই সুন্দর মায়ের মন্দির। গর্ভগৃহে একটি শিলা খন্ড মাতৃ জ্ঞানে পূজিতা হন। দ্বিতল মন্দিরে রয়েছে হনুমান, কৃষ্ণ এবং মা কালীর মতো আরও অনেক দেবদেবীর মূর্তি। মন্দিরটি ৫০০ বছরেরও বেশি পুরনো বলে মনে করা হয়।
মুক্তাইচন্ডী হলেন লৌকিক দেবী, কিন্তু এখন তা শক্তিপীঠ। সতীর মৃত্যুর খবরে ক্রুদ্ধ শিব তখন সতীর দেহ নিয়ে তান্ডব নৃত্য করছেন, সেই সময়ে নাকি সতীর নাকছাবির মুক্তোটি ছিটকে পরে বর্তমান স্থলে, তাই এই জায়গাটির নাম মুক্তাইচন্ডী শক্তিপীঠ।
টিলার পিছনের অংশ বেশ সুন্দর শান্ত, সবুজে ঢাকা। চারপাশেও অনেক গাছপালা রয়েছে।
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে মেলা হয়, অনেক ভক্তের সমাগম হয়।
নীচে জুতো খুলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। মন্দিরটি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। মন্দির চত্ত্বর একেবারে ফাঁকা, কেউ আশেপাশে নেই। মায়ের দর্শন করার পর মন্দিরের উপর বাকি মূর্তিগুলি দেখলাম। তারপর গেলাম টিলার পিছনের দিকের শান্ত সবুজে ঘেরা চত্ত্বরে। এই জায়গা টি খুবই সুন্দর। সেখানে সিঁড়িতে সবুজের ছায়াতে বেশ অনেকক্ষন বসে রইলাম। চারপাশে সবুজে ঘেরা মনোমুগ্ধকর পরিবেশে এই শান্ত নির্জন মন্দির চত্ত্বরটি এক কথায় অসাধারণ।
উঠতে ইচ্ছা না করলেও ঘড়িতে এখন সময় সকাল ১০:৪০। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে চলে এলাম। এরপর যাব পরবর্তী গন্তব্য ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতার মন্দির।
3. ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতার মন্দির
মুক্তাই চন্ডী পাহাড় থেকে ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতার মন্দির ২০ কিমি দূর। Google map দেখে সকাল ১১:১৫ তে পৌঁছে গেলাম হাইওয়ের পাশেই ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতার মন্দিরের সামনে। একটি গাছের নীচে গাড়ি রাখলাম। এবার গরম একটু বাড়ছে।

আসানসোলে শীর্ণকায়া নুনিয়া নদীর তীরে অবস্থিত এই ঘাগর বুড়ি চন্ডী মাতার মন্দির। এটি আসানসোলের প্রাচীনতম মন্দির যা ১৬২০ খ্রিস্টাব্দে অতুল প্রসাদ চক্রবর্তী নির্মাণ করেছিলেন। মা ঘাগর বুড়ি নামে পরিচিত দেবীকে মা চণ্ডীর অন্যতম অবতার বলে মনে করা হয়। দেবীর মূর্তিটি তিনটি পাথরের টুকরো যা সর্বদা রূপার অলঙ্কারে পরিপূর্ণ থাকে।
মন্দিরের নামকরণ করা হয়েছে প্রায় ৫৫০ বছর আগে কাঙালি চরণ চক্রবর্তী নামে এক পুরোহিতের স্বপ্ন থেকে। কাঙালি চরণ ছিলেন একজন পরিশ্রমী পুরোহিত যিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। একদিন, প্রতিদিনের কাজ থেকে ফিরে আসার সময় ক্লান্ত হয়ে তিনি মন্দিরের বর্তমান অবস্থানের কাছে একটি পিপল গাছের নীচে ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে কালী দেবীর রূপে একজন 'ঘাগড়া' পরিহিতা বৃদ্ধা মহিলা তার সামনে আবির্ভূত হচ্ছেন এবং তাকে পূজা করতে বলছেন। ঘুম থেকে ওঠার পর তিনি ঠিক যেখানে দেবী স্বপ্নে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক সেখানেই তিনটি বড় পাথরের টুকরো দেখতে পান। সেই থেকে, শতাব্দী ধরে তিনটি পাথরের পূজা হয়ে আসছে। মাঝের পাথরটি ঘাগর বুড়ি মাতার প্রতিনিধিত্ব করে, বাম পাথরটি দেবী অন্নপূর্ণার প্রতিনিধিত্ব করে এবং ডান পাথরটি পঞ্চানন মহাদেবের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
মন্দিরে ছাগল বলির একটি রীতি আছে, যা মা ঘাগর বুড়ির প্রধান প্রসাদ হিসেবে বিবেচিত হয়। মন্দির প্রাঙ্গণের প্রবেশপথে নারকেল, মালা, মিষ্টি, ধূপকাঠি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পূজার জিনিসপত্র বিক্রির জন্য একাধিক স্টল রয়েছে।
মূল মন্দিরের ঠিক বাইরে একটি বিশাল পিপল গাছ রয়েছে। লোকেরা বিশ্বাস করে যে, কেউ যদি গাছের কাণ্ডে সুতো বেঁধে দেবী ঘাগর-মাতার কাছে কোন ইচ্ছা পোষণ করে, তাহলে তা পূরণ হয়।
আমি মন্দিরের বাইরে একটি স্টল থেকে পূজার সামগ্রী নিয়ে মন্দিরের ভিতর পূজা দেওয়ার জন্য প্রবেশ করলাম। মন্দিরের ভিতর খুব একটা ভিড় ছিল না। মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকেই আমি এমন এক শান্তি ও ভক্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম যা কেবল এই পবিত্র স্থানই প্রদান করতে পারে। মায়ের দর্শন করে পূজা করিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে মন্দির থেকে বের হলাম। মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করার পর মন্দিরের পাশেই একটা খাবারের স্টলে গেলাম। সকাল থেকে অনেক ঘুরছি খুব খিদে পেয়েছে। কচুরি আর ঘুগনি খেলাম সেখানে।
খাওয়ার পর গাড়ির কাছে এলাম। এখন ঘড়িতে সময় দুপুর ১২ টা। এখন একটু গরম লাগছে। রোদের তাপ বাড়ছে এবার। আজকের ঘোরাঘুরি এই পর্যন্তই। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। তারপর বাড়ি ফিরে গাড়িটা পরিষ্কার করতে হবে তবে আমি শান্তি পাব।
ঘাগর বুড়ি চন্ডি মাতার মন্দির থেকে ১২ টায় বেরোলাম। সেখান থেকে দুর্গাপুর আসার পর রাস্তার ধরে একটা ধাবা তে দাঁড়ালাম। খুব রোদের তাপ। ধাবায় ঢুকে দই খেলাম। তারপর সেখানে কিছুক্ষন বসে আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

দুপুর ২:৪৫ -এ বাড়ি পৌঁছালাম। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে গাড়ি পরিষ্কার করতে শুরু করলাম। WD-40 দিয়ে এবং কাপড়ের টুকরো দিয়ে ভালো করে পরিষ্কারের পর দুবার Bike washing Shampoo দিয়ে ভালো করে গাড়ি টা ধুলাম। অনেক টাই পরিষ্কার হয়ে গেল। বাকি mudguard-এর ভিতরেও এখনো ওই চ্যাটচ্যাটে জিনিসটা লেগে রয়েছে, আবার পরে সব খুলে ভালো করে পরিষ্কার করব। আপাতত গাড়ি টা পরিষ্কার হয়ে মন টা অনেকটা হালকা লাগছে।
আজ গল্প এই পর্যন্তই। যারা আমার website-এ প্রথমবার গল্প পড়ছো, আমার এই গল্প টি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই আমার বাকি গল্প গুলো পড়তে ভুলো না। আমার গল্প ভালো লেগে থাকলে নীচে দেওয়া Share link থেকে বন্ধুদের share করো। খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি আবার এক travel story নিয়ে। Keep visiting my website...