08/05/2025 : Thursday
Trip No.: - 25আমার স্কুল এখন Summer vaccation চলছে কিন্তু গরম সেরকম এখনো পড়েনি তাই এই সময় ছুটিতে একটু ঘোরাঘুরি করাই যায়। কিছুদিন ধরেই ইচ্ছা করছে একটু নদীর ধারে গিয়ে একটু নির্জনে কিছুটা সময় কাটাতে। ভাবছিলাম গঙ্গার কোনো এক ঘাটে যাবো যেখানে প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম হবে আবার বাবুঘাট বা প্রিন্সেপ ঘাটের মত বেশি crowd হবে না।
Google map-এ খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম একটা সুন্দর গঙ্গার ঘাট। পানিহাটির বারো মন্দির ঘাট। উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুর subdivision এর অন্তর্গত পানিহাটি অঞ্চলের গঙ্গার ধারে অবস্থিত এটি একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থান। এই ঘাটটি তার বারোটি শিব মন্দিরের জন্য বিখ্যাত, যা সারি বেঁধে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। এই জন্যেই এই ঘাটের নাম হয়েছে বারো মন্দির ঘাট।
গঙ্গার ঘাটে যাওয়ার best time হচ্ছে খুব সকালে আর নাহলে বিকালের পর। বিকালের পর একটু ভিড় থাকে তাই আমি ঠিক করলাম খুব সকালে সূর্যোদয়ের সময় যাবো। আজ পর পর দুটো tour করব। প্রথমে তো এই পানিহাটির গঙ্গার ঘাট তারপর যাবো চাকদহতে এক প্রাচীন জমিদারবাড়ি দেখতে।
সমস্ত preparation নিয়ে আজ ভোর ৪ টায় বাড়ি থেকে বেরোলাম। বর্ধমান থেকে শক্তিগড় পেরোনোর পর রাস্তার ধরে দাঁড়িয়ে চা-বিস্কুট খেয়ে নিলাম (ফ্লাস্কে করে চা করে এনেছিলাম)। তারপর শক্তিগড় থেকে রসুলপুর-মেমারী-পাণ্ডুয়া-মগরা হয়ে ঈস্বরগুপ্ত সেতু পেরিয়ে Kalyani Expressway ধরলাম। সেখান থেকে Kalyani Expressway ধরে ব্যারাকপুরের উপর দিয়ে টিটাগড় পেরিয়ে সোদপুরের পাশ দিয়ে এসে পৌঁছালাম খড়দহ তে "Dada Boudi Restaurant"-এর সামনে। সেখানে "Dada Boudi Restaurant"-এর সামনের হরিশ চন্দ্র দত্ত রোড ধরে এগিয়ে চললাম হুগলী নদীর দিকে।
Google map দেখে সকাল ৭টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম বারো মন্দির ঘাট। ঘাট থেকে সামান্য দূরত্বে গাড়ি রাখার parking area আছে কিন্তু সকালে অত ভিড় না থাকার জন্য আমি ঘাটে যাওয়ার গেটের পাশেই স্কুটি টা রাখলাম। তারপর গেট দিয়ে প্রবেশ করে ঘাটের দিকে এগিয়ে চললাম।
উত্তর ২৪ পরগণা জেলার ব্যারাকপুর subdivision এর অন্তর্গত পানিহাটি অঞ্চলের গঙ্গার ধারে অবস্থিত এই বারো মন্দির ঘাট আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে বাংলার ১২১৩ সালে শ্রী নবীন চন্দ্র দত্ত দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। নবীন চন্দ্র দত্ত তাঁর পিতা হরিশ চন্দ্র দত্তের স্মরণে বারোটি সংলগ্ন শিব মন্দির সহ ঘাটটি নির্মাণ করেছিলেন।
ইতিহাস অনুসারে, কলকাতায় গঙ্গায় শ্রী হরিশ চন্দ্র দত্ত 'তর্পণ' অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণের সময়, তিনি একজন গর্ভবতী মহিলাকে জলভর্তি কলসি বহন করার সময় ঘাটের সিঁড়িতে পড়ে যেতে দেখেন এবং ঘটনার পরপরই গর্ভপাতের কারণে সেই মহিলা সেখানেই মারা যান।
এই ঘটনার পর হরিশচন্দ্র এমন একটি ঘাট তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন যাতে যেকোনো গর্ভবতী মহিলা সহজেই যেতে পারেন। এভাবে তাঁর নির্দেশে ঘাটটি তৈরি করা হয়। নবীনচন্দ্র দত্ত ঘাটের কাছে বারোটি সংলগ্ন শিব মন্দিরও নির্মাণ করেন। শিবলিঙ্গ কালো পাথর দিয়ে তৈরি।
১৯২৪ সালে কালনা থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত গঙ্গার জরিপের পর, তৎকালীন কলকাতা বন্দর কমিশনার বলেছিলেন যে - "গঙ্গার তীরে আর কোনও ঘাট এত প্রশস্ত, এত সহজে আরোহণযোগ্য এবং দেখতে এত সুন্দর নয়। ভাটার সময়েও এটি কখনও শুকিয়ে যায় না।"
ঘাটের ধাপগুলি মাত্র ৪ ইঞ্চি উচ্চতার, যা ঘাটে আরোহণকে সহজ করে তোলে। এই ঘাটটি নির্মাণের উপদেষ্টা ছিলেন প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমনি মিত্র এবং এই ঘাটের প্রবেশদ্বারের portico-র ডিজাইন করেছিলাম স্যার ব্র্যাডফোর্ড লেসলি।

সকাল ৭ টায় বারো মন্দির ঘটে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম মাথার উপর দিয়ে পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছে। ঘাটের সামনে একজন ব্যক্তি পায়রাকে দানা খাওয়াচ্ছিলেন। দেখলাম অনেকে ঘাটের ধরে প্রাতঃ ভ্রমণ করছেন। সব মিলিয়ে খুব সুন্দর মনোরম এক সকালের পরিবেশ। দেখে মন ভরে গেল। ঘাটের চারপাশ খুব ই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, যা দেখে আরো বেশি ভালো লাগল। ঘাটে যাওয়ার জন্য যে portico বা বারান্দা আছে তা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে কিছুটা নেমে গিয়ে দেখলাম পাশে সুন্দর বসার জায়গা, অনেকেই ওখানে বসে প্রাকৃতিক শোভা উপভোগ করছেন। আমিও সেখানে গিয়ে বসলাম আর সামনে শান্ত নদীর এবং চারপাশের নির্জন প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে লাগলাম। নদীর ধরে ৩০ মিনিট বসার পর এবার আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে শিবমন্দিরগুলি দেখতে গেলাম।
ঘাটের দুই পাশে ৬ টি করে মোট ১২ টি শিবমন্দির রয়েছে যেগুলিতে নিত্য পুজো হয়। এই কারণেই এই ঘাটটির নাম বারো মন্দির ঘাট। মন্দিরগুলির সামনের জায়গা বেশ গাছপালায় ঘেরা। প্রাতঃ ভ্রমণ করতে আসা অনেকজনকে সেই গাছপালার নিচে বসে দৈনন্দিন জীবন নিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে দেখলাম।
এখন ঘড়িতে সময় সকাল ৮ টা। বারো মন্দির ঘাট থেকে বেরিয়ে গেলাম। সব মিলিয়ে আজ সকালের এই হুগলী নদীর তীরে ঘটে কিছুক্ষন সময় বেশ ভালোভাবে কাটলো। ইচ্ছা করছিলো আরো কিছুক্ষন বসে থাকার কিন্তু এরপর আরো একটি জায়গা যাবো তাই সময়ের বাধ্যবাধকতায় বেরিয়ে পড়তে হল। এখন যাবো চাকদহ তে একটা প্রাচীন জমিদারবাড়ি দেখতে।
খড়দহ থেকে বেরিয়ে Kalyani Expressway ধরে চাকদহের দিকে Google map দেখে দেখে এগিয়ে চললাম। এলাম সিংহের-বাগান মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে turn নিয়ে চাকদহ নিমতলা রোড ধরে এগিয়ে চললাম। এসে পৌছালাম বনমালীপাড়া। Google map দেখে এবং একজন স্থানীয় বয়স্ক মানুষকে একটু জিজ্ঞাসা করে আম ও অন্যান্য বড় গাছ দিয়ে আবৃত একটি জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। রাস্তা খুব ই খারাপ। ওই গাছপালার মধ্যে দিয়েই Google map দেখে কোনোরকমে এগিয়ে চললাম। অবশেষে আম-কাঁঠাল গাছের জঙ্গল পেরিয়ে এসে পৌছালাম খড়দহের রায় বাড়ি। ঘড়িতে এখন সময় সকাল ১০ টা। জমিদার বাড়ির সামনে গাড়ি রেখে বাড়ির মূলদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। এখানে বিকালের দিকে একটু ভিড় থাকে কিন্তু এই সময় একেবারে ফাঁকা।

নদীয়া জেলার চাকদহের বনমালীপাড়ায় অবস্থিত এই ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়িটি রায় বাড়ি বা রায় জমিদারবাড়ি নামেই খ্যাত। এই রায়বাড়ির নাম হয় জমিদার কেদারনাথ রায়ের বংশধরের পদবি অনুসারে। কেদারনাথ রায়ের বংশধর ধীমান রায়ের ৭ পুত্র ছিল। তাদের মধ্যে বড় ছেলের নাম ছিল তপা রায়। আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে প্রায় ৯ বিঘা জমির উপর এই বাড়িটি নির্মাণ করিয়েছিলেন তপা রায়, যিনি ১২০০ বিঘা জমির মালিক ছিলেন।
কথিত আছে এই বাড়িটি নির্মাণের জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে বেশ কিছু যুবক মিস্ত্রি আনা হয়। তারা একটি কাঁঠাল খেয়ে তার একটি বীজ রোপন করে বাড়ির কাজ শুরু করেন, এবং সেই কাজ শেষ হয় তাদের বার্ধক্যে ওই বীজ থেকে হওয়া গাছের কাঁঠাল খেয়ে।
জঙ্গলে ঘেরা, একতলা এই বাড়িতে রয়েছে ২৪ টি ঘর, সাল ও সেগুন কাঠের তৈরী সানসেট। শোনা যায় এখানে এক সময় ছিল ১৪ টি ইটের তৈরি টিনের ছাউনি দেওয়া ধানের গোলা এবং ২ টি পালকি।
এক সময় এই বাড়িটি খুবই বিলাসবহুল ছিল কিন্তু কালের নিয়মে ১৯৮৩ সাল থেকে এই বাড়িটি সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়ে যায়।

বর্তমানে বাড়িটি একেবারে ভগ্নপ্রায়। সিমেন্টের প্লাস্টার ছেড়ে ইটগুলি দেখা যাচ্ছে। চারপাশে বড় বড় গাছপালা গজিয়ে উঠেছে। অনেক জায়গায় ছাদ ভেঙে পড়েছে। একজন বংশধরের কাছ থেকে এই বাড়ির ইতিহাস জেনে এবং নিচের ঘরগুলি দেখার পর একপাশে অন্ধকারাচ্ছন্ন সিঁড়ি দিয়ে উপরে বাড়ির ছাদে উঠে গেলাম।
বাড়ির ছাদ থেকে চারপাশ খুব সুন্দর লাগছিল। অদূরে জমিদারবাড়ির পারিবারিক পুকুরটি দেখা যাচ্ছে। এই পুকুর থেকেই মাটি তুলে ইঁট বানিয়ে চুন-সুরকি দিয়ে এই বাড়ি তৈরী হয়েছিল। ছাদের একপাশে রয়েছে ভগ্নপ্রায় লক্ষী-নারায়ণ মন্দির, যার মাথায় এখন একটি বটগাছ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ছাদ থেকে নিচে নেমে এসে বাইরে বেরিয়ে এবার চললাম রায় বাড়ির পারিবারিক পুকুরের দিকে। পুকুরে জল বেশি নেই। পুকুরের পার থেকে চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে পুকুরের মাঝে। সেই সিঁড়ির পশে কিছুক্ষন বসলাম। পুকুর থেকে জমিদারবাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম - আজ যা ধ্বংসস্তূপ তা একসময় মানুষজন, লোকলস্করে গমগম করতো। ভাবতে বেশ অবাক লাগছিল। সময়ের এই খেলাটা চিরকাল আমায় আকৃষ্ট করেছে।
আমি আজ বাড়ি থেকে খাবার করে এনেছিলাম - লুচি, আলুর দম আর মিষ্টি। গাড়ির toolbox থেকে টিফিনবাক্স আর জলের বোতল বের করে নিয়ে আবার ঘাটের ধারে চলে এলাম। এখানে ঘাটের ধারে গাছের ছায়ায় বসে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম।
খাওয়া শেষ করে দেখি ঘড়িতে ১১:১৫ বেজে গেছে। এবার গরম ও একটু বাড়ছে। এবার বাড়ি ফিরতে হবে। আজকের মতো ঘোরাঘুরি শেষ। এই ঐতিহাসিক জমিদারবাড়ির বংশধরেরা জমিদারবাড়ি টি বাদে তাদের বাকি সম্পত্তির সবকিছুই বর্তমানে বিক্রি করে ফেলেছে। এখন এই বাড়িটিরও অবস্থা খুব ই খারাপ। এই বিশাল বাড়িটির সংস্কারের খুবই প্রয়োজন নাহলে আর কয়েকবছর পর এর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
সকাল ১১:১৫ তে চাকদহ ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম। চাকদহ থেকে কল্যাণী হয়ে মগরা এসে সেখান থেকে মগরা ব্রিজ পেরিয়ে বাঁদিকে নিয়ে গুড়াপ এলাম। গুড়াপ থেকে Durgapur Expressway ধরে বাড়ি চলে এলাম। দুপুর ২:১৫ তে বাড়ি চলে এলাম। এবার স্নান-খাওয়া করব। সকালের দিকে খুব একটা গরম লাগে নি। ফেরার সময় ভালোই গরম ছিল।
আজ গল্প এই পর্যন্তই। যারা আমার website-এ প্রথমবার গল্প পড়ছো, আমার এই গল্প টি ভালো লেগে থাকলে অবশ্যই আমার বাকি গল্প গুলো পড়তে ভুলো না। আমার গল্প ভালো লেগে থাকলে নীচে দেওয়া Share link থেকে বন্ধুদের share করো। খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি আবার এক travel story নিয়ে। Keep visiting my website...