07/02/2025 : Friday
Trip No.: - 15পাথরা হল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় কংসাবতী নদীর তীরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে রয়েছে অনেক টেরাকোটা মন্দির এবং পুরাকীর্তি। আজ থেকে প্রায় ২৫০ - ৩০০ বছর আগে এই গ্রাম টা হয়ে উঠেছিল সম্মৃদ্ধশালী এবং মন্দিরময়। সেই সমস্ত ইতিহাসের সন্ধানে আজ আমি চলেছি পাথরা। কিছুদিন আগে Google Map-এ মেদিনীপুরের এই দিকে ঘোরার মত কী কী ভালো ভালো জায়গা আছে দেখতে দেখতে এই জায়গাটার সন্ধান পাই। তারপর ভালোভাবে study করে নিয়ে আজ আমার স্কুলে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি পাথরার উদ্দেশ্যে।
আজ ভোর ৫ টায় বাড়ি থেকে বেড়িয়েছি। বর্ধমান থেকে সেহারাবাজার হয়ে উচালন থেকে ডানদিকে একলক্ষী-র রাস্তা ধরে চলে এলাম কামারপুকুর। কামারপুকুরে এসে একবার দাঁড়ালাম, সামান্য কেক বিস্কুট খেয়ে আবার যেতে শুরু করলাম। এরপর Google map দেখে চন্দ্রকোনা টাউন, রামজীবনপুর হয়ে একেবারে পৌছালাম পাঁচখুরি। দেখলাম পাঁচখুরি থেকে হোসনাবাদ হয়ে পাথরা যেতে হলে প্রায় ১৫ কিমি রাস্তা, তবে এই পাঁচখুরি থেকে বামদিকে নিয়ে রাস্তা ধরলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর দেখলাম রাস্তা খুব একটা ভালো না। তাও চলে এসেছি যখন এই দিকেই যেতে হবে। কুলদা ব্রিজ পেরোনোর পর এমন একটা রাস্তায় এসে পড়লাম, মাটির সরু উঁচু - নিচু রাস্তা, যা গাড়ি নিয়ে যাওয়ার রাস্তাই নয়, totally offroad, স্কুটি নিয়ে তো খুব সমস্যা; যাইহোক ওই offroad শেষ করে ভালো পিচরাস্তা পেলাম। তারপর ভালোভাবেই Google map দেখে চলে এলাম পাথরা। ঘড়িতে এখন বাজছে সকাল ৯:১৫। Shortcut নিতে গিয়ে প্রায় ৩.৫ কিমি offroading করতে হল।
পাথরার ইতিহাস টা প্রথমেই একটু বলে দিই: -
প্রায় ৩০০ বছর আগের কথা। তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের এই অঞ্চল ছিল রতনচক পরগনার অধীনে। নবাব আলীবর্দী খাঁ-র আমলে সেই সময় রতনচক পরগনার নায়েব পদে নিযুক্ত হন - বিদ্যানন্দ ঘোষাল। তিনি তাঁর এক গুরুর পরামর্শে আদায়ীকৃত খাজনার অর্থের সাহায্যে মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তা জানতে পেরে আলীবর্দী খাঁ রুষ্ট হন এবং বিদ্যানন্দকে পাগলা হাতির পায়ের তলায় ফেলে হত্যার আদেশ দেন নবাব। কিন্তু সেই পাগলা হাতি বিদ্যানন্দকে সামনে পেয়েও থমকে যায়। নবজীবন পান বিদ্যানন্দ। নবাব এই ঘটনায় বিস্মিত হন এবং সবকিছু মেনে নিয়ে রতনচক পরগনার জমিদারি দান করেন বিদ্যানন্দকে। সেই ঘটনা থেকেই এই জায়গার নাম হয় - "পা-উথরা" বা "পাথরা"।
ধীরে ধীরে মন্দিরের সংখ্যা বাড়তে থাকে ও রতনচক পরগনা তথা পাথরা হয়ে ওঠে এক মন্দিরময় ও সমৃদ্ধশালী গ্রাম। বিদ্যানন্দ ঘোষাল মজুমদার উপাধি পান। বিদ্যানন্দের কৃতিত্বের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে কোলাহলমুখর হয়ে ওঠে রতনচক। ঘোষাল বংশের পরবর্তীতেও আরও অনেক মন্দির তৈরী হয় এখানে। মোট মন্দিরের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়, যার বেশিরভাগই ছিল শিবমন্দির।
পরবর্তী ২৫০ বছর পর কালের গর্ভে তলিয়ে যেতে থাকে মন্দিরগুলি।
সেই ১০০ টি মন্দিরের একটিও হয়তো অবশিষ্ট থাকতো না যদি না ঠিক সময়ে রুখে দাঁড়াতেন একজন সাধারণ স্কুলের কর্মী মহঃ ইয়াসিন পাঠান। তাঁর বাড়ি পাথরা থেকে ২ কিমি আগে হাতিহালকা গ্রামে। তিনি অন্য ধর্মের মানুষ হয়েও বহু প্রতিকূলতা কাটিয়ে এখানকার প্রাচীন হিন্দু মন্দির এবং সংস্কৃতিকে রক্ষার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর দীর্ঘ লড়াইয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রপতি শঙ্করদয়াল শর্মার হাত থেকে পেয়েছেন 'কবীর পুরস্কার', ভারতের ইতিহাস গবেষণা পর্ষদ তাঁকে দিয়েছে সাম্মানিক 'ডরেট' ডিগ্রি। এছাড়াও আরও কত পুরস্কার আর সম্মান রয়েছে তাঁর ঝুলিতে।
আজ তাঁর জন্যই ASI অবশিষ্ট মন্দিরগুলিকে রক্ষা করতে পেরেছে এবং আমি আজ এখানে তা দেখতে এসেছি।

Google map দেখে পাথরায় পৌঁছানোর পর প্রথমেই বামদিকে এক জায়গায় দেখলাম ASI-এর সংস্কার করা পর পর অনেকগুলি মন্দির। কালাচাঁদ মন্দির এবং পাশাপাশি তিনটি আটচালা শিবমন্দির এবং তার পশে রয়েছে এক অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ।
মন্দির গাত্রে একটি ভাস্কর্য দেখলাম যা - বাইরে কাজ করতে যাওয়া মানুষের ফেরার জন্য অপেক্ষারত কোনো মহিলা। মুর্শিদাবাদের শ্রমিকরা এই মন্দিরগুলি নির্মাণের কাজ করেছিলেন। সম্ভবত তাদের পরিবারের কথাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই ভাস্কর্যে।
এরপর কালাচাঁদ মন্দিরের পাশেই দেখলাম ল্যাটেরাইট পাথরের নির্মিত একটি ছাদ-বিহীন দুর্গামণ্ডপ।
দুর্গামণ্ডপের সামনেই রয়েছে আটচালা মন্দির ও পঞ্চরত্ন মন্দির। এই মন্দিরগুলি অনেকটা মাটির নিচ থেকে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছিল। টেরাকোটার মন্দিরগুলিতে রয়েছে ইসলামিক কারুকার্যের ছোঁয়া।
এরপর রাস্তার অপর প্রান্তে কংসাবতী নদীর তীরে দেখলাম একটি আটচালা মন্দির ও নবরত্ন মন্দির। এই নবরত্ন মন্দিরটি হল সবচেয়ে বড় ও সুন্দর মন্দির যা অষ্টাদশ শতকে নির্মিত। এর পশে রয়েছে একটি তুলসীমঞ্চ।
এই নবরত্ন মন্দিরটি থেকে একটু পিছিয়ে এসে কংসাবতী নদীর তীরে দেখলাম ঊনিশ শতকে নির্মিত ধর্মরাজ মন্দির।
এরপর গাড়ি নিয়ে আরো সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বামদিক দিয়ে যে রাস্তা যাচ্ছে সেদিকে ঢুকে পড়লাম পাথরা গ্রামের ভিতর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের মন্দির দেখার জন্য।
এখানে এসে দেখলাম পাশাপাশি তিনটি পঞ্চরত্ন মন্দির। মন্দিরগাত্রে দ্বাররক্ষীর মূর্তি খোদাই করা। ১৮১৬ সালে রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক ব্যক্তি এই মন্দিরগুলির নির্মাণ করেছিলেন।

মন্দিরগুলির পাশেই রয়েছে ভগ্নপ্রায় কাছারিবাড়ি, যার মধ্যে রয়েছে চোরাকুঠুরি ও সুড়ঙ্গের চিহ্ন। এর পশে রয়েছে একটি ছোট রাসমঞ্চ। এই জায়গা গুলিতে ঘুরতে ঘুরতে যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই ৩০০ বছর পুরানো রতনচক পরগনার ইতিহাসের পাতায়।
ঘড়িতে এখন সময় ১১:৩০। পাথরা ঘোরা শেষ। এবার ফেরার পালা। পাথরা গ্রামের একগুচ্ছ ইতিহাস সাথে নিয়ে বেরিয়ে এলাম গ্রাম থেকে। ফেরার সময় আগের বারের ওই রাস্তা টা avoid করলাম কিন্তু এবার অন্য একটা shortcut রাস্তা নিলাম, জমির আলপথ দিয়ে বেশ অনেক টা রাস্তা যেতে হল। জমির আলপথ মানে তোমরা বুঝতেই পারছো রাস্তা অসমান কিন্তু আসার সময়কার রাস্তা থেকে কিছুটা ভালো। scooty নিয়ে এই ধরণের রাস্তা দিয়ে চালানো খুব চাপের ব্যাপার। যাইহোক জমির আলপথ দিয়ে ৩ কিমি যাওয়ার পর main road-এ উঠলাম।
অল্প করে বিস্কুট খেয়ে নিলাম। কারণ আজ কোথাও breakfast করব না, একেবারে lunch করব।
আবার সেই চন্দ্রকোনা হয়ে কামারপুকুরের দিকের রাস্তা ধরলাম। ফেরার সময় চন্দ্রকোনার কিছু আগের রাস্তা টা খুব সুন্দর লাগছিল। মাথার উপর সূর্য, নীল আকাশ, দুপাশে সুদূর বিস্তৃত সবুজ ধান জমি, মাঝে পিচ রাস্তা দিয়ে চলেছি, ফাঁকা রাস্তা। খুব সুন্দর গ্রাম বাংলার পরিবেশ।
চন্দ্রকোনা টাউন পেরোনোর পর কামারপুকুর ঢোকার কিছু আগে "Star Hotel & Restaurant"-এ ঢুকলাম। ওই রোডে এটাই বেশ premium restaurant. ঘড়িতে এখন বাজে দুপুর ১:১৫। এখন এখানে lunch করব। Order করলাম full plate "Chicken Biryani". ১৫ মিনিট পর খাবার এলো। বিরিয়ানিতে ছিল 2 pieces chicken, 1 piece potato, 1 piece egg. দাম মাত্র ১১০ টাকা। খাবারের quality, chicken quality খুবই ভালো ছিল। খাওয়ার পর একটু বসে পেমেন্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। সকালে যেরকম ঠান্ডা ছিল এখন বেশ গরম করছে।
এরপর restaurant থেকে বেরিয়ে কামারপুকুর ঢোকার আগে একটা HP petrol pump থেকে গাড়িতে সামান্য তেল ভরলাম। তারপর কামারপুকুর থেকে আবার বেঙ্গাই - একলক্ষী রোড ধরলাম। রোদের তাপ বেশ ভালোই আছে। বেঙাই পেরোনোর পর রাস্তার ধারে একটা গাছের তলায় কিছুক্ষন দাঁড়ালাম।
তারপর আবার একলক্ষী - উচালন - সেহারাবাজার হয়ে বাড়ি চলে এলাম। বিকাল ৪ টার মধ্যেই বাড়ি চলে এলাম। এবারের tour টা আগের গুলোর থেকে একটু longer ছিল। শুধু ওই পাথরা ঢোকার আগে কিছু তা রাস্তা খারাপ পেয়েছিলাম shortcut নিতে গিয়ে, তাছাড়া আর কোনো সমস্যা হয় নি। দুপুরে lunch টাও ঠিকঠাক হয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি আবার মেদিনীপুরেরই অন্য এক special travel story নিয়ে। Keep visiting my website and share with your friends 👍.